banner
bangla-bar

 

৮ই মার্চ, ক্লারা জেটকিন স্মরণে

ফারুক চৌধুরী
অনুবাদক: সৈয়দা আফিয়া মাসুমা

[প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে কাউন্টার কারেন্টসে, ২০২০ সালের ৮ই মার্চ তারিখে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসে। মূল প্রবন্ধের লিংক: https://countercurrents.org/2020/03/remembering-clara-zetkin-on-march-8। ক্লারা জেটকিনের জন্মদিন উপলক্ষ্যে প্রবন্ধটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়েছে নব গণগ্রন্থের ওয়েবসাইটে (www.nggbooks.wordpress.com), ২০২০ সালের ৫ই জুলাই তারিখে। লেনিনের সাথে ক্লারার কথোপকথনের অংশটি ব্যতীত প্রবন্ধটির বাকি অংশ অনুবাদ করেছেন অনুবাদক। কথোপকথনের অংশটুকু প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন হতে প্রকাশিত বই হতে গৃহীত।]

ক্লারা জেটকিন, শ্রমজীবী শ্রেণির এক সন্তান। শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম জীবন ও মর্যাদার অধিকার আদায়ের জন্য। আর, এ সংগ্রামের ইতিহাসে ক্লারা জেটকিন সদা উজ্জ্বল। প্রলেতারীয় সংগ্রাম, দৃঢ়তা ও বীরত্বের প্রতিমূর্তি ক্লারা সব সময় সর্বহারা মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। তিনি নারী সংক্রান্ত প্রশ্নটিকে কখনোই বুর্জোয়া দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখে দ্বিধাগ্রস্ত হন নি।

লেনিন ও রোজা লুক্সেমবার্গের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা ক্লারা (৫ই জুলাই, ১৮৫৭ - ২০শে জুন, ১৯৩৩) প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন আয়োজন করেছিলেন। মার্কসবাদী এ রাজনীতিবিদ সব সময় নারীদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে আন্তরিক ছিলেন। ক্লারা ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত ওয়েমার রিপাবলিক পর্বের আইনসভায় জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।

শ্রমজীবী মানুষের এ সংগঠক সব সময় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর মর্যাদা ও সমঅধিকারের জন্য সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করে গিয়েছেন। নারীদের, বিশেষ করে শ্রমজীবী শ্রেণির নারীদের রাজনৈতিক সংগ্রামের ক্ষেত্রেও প্রধান সংগঠকদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এসপিডি) নারীবিষয়ক মুখপত্র ডাই গ্লাইসাইট (Die Gleichheit বা সমতা) এর সম্পাদক ছিলেন ক্লারা। উল্লেখ্য, সে দিনের এসপিডির রাজনীতি ও আদর্শের সাথে আজকের এসপিডির আমূল পার্থক্য রয়েছে। সম্পাদক হিসেবে লেখনীর মাধ্যমে প্রলেতারীয় নারীদের রাজনৈতিক বিষয়ে সোচ্চার হতে তিনি কাজ করেছিলেন।

নারী সমতা অর্জনের জন্য সংগ্রামরত মানুষেরা আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে রূপ দেয়ার ক্ষেত্রে ক্লারা জেটকিনের ভূমিকা কখনো ভুলে যাবেন না।

দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক এর সাধারণ সভার প্রস্তুতি হিসেবে ১৯১০ সালের আগস্টে আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা তাঁদের অধিকার আদায়ের লড়াইতে বড় ধরনের অগ্রগতি সাধন করেছিলেন। এ প্রেক্ষাপটে, ক্লারা এবং তার সহযোদ্ধারা সম্মেলনে একটি বাৎসরিক নারী দিবসের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছিল এবং ১৯১১ সালের ১৯শে মার্চ দেশে-দেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছিল। সেটিই ছিল পৃথিবীজুড়ে দিবসটির প্রথম উদ্‌যাপন। জার্মানি, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে লক্ষ লক্ষ নারী এ দিনে পদযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন।

ক্লারা বুর্জোয়া নারীবাদের তীব্র বিরোধী ছিলেন। এ নারীবাদ সংকীর্ণতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিষয়টিকে দেখে। পূর্বের ন্যায় আজও বুর্জোয়া শ্রেণির নারীদের কাছে এটি প্রধানত একটি চলতি ফ্যাশন। ক্লারার মতে বুর্জোয়া নারীবাদ হচ্ছে শ্রমজীবী জনগণের মধ্যে বিভেদ তৈরি করার, শ্রমজীবী জনগণকে বিভ্রান্ত করার, শ্রমজীবী জনগণকে বুর্জোয়া আদর্শ ও রাজনীতির অনুসারী করারই একটি কৌশল। বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষার জন্য এটা হচ্ছে বুর্জোয়াদের একটি শক্তিশালী অস্ত্র। বাংলাদেশ ও ভারতসহ নানা দেশে রাজনীতির সকল ক্ষেত্রে অন্যান্য সংকীর্ণতাবাদী পন্থা যেভাবে প্রবলভাবে বিরাজ করছে, নারী বিষয়ে এই সংকীর্ণতাবাদী ধারণাটিও সেভাবেই রয়েছে।

তিনি কখনও মূল বিষয়টি এড়িয়ে যান নি। এ মূল বিষয়টি হচ্ছে: প্রলেতারীয় নারীদের, দরিদ্র নারীদের, শ্রমজীবী নারীদের বুর্জোয়া ধারণা, বুর্জোয়া রাজনীতি, বুর্জোয়া কার্যপদ্ধতি, বিভাজনের পন্থা, আংশিকভাবে দেখার রীতিনীতি - এ সব ধ্যানধারণা ছুঁড়ে ফেলতে হবে। এ ধ্যানধারণা ও পন্থা বর্জন করা ছাড়া শোষিত নারীরা কখনই অসমতা ও বৈষম্যের শিকল থেকে, শোষণ, অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্ত হতে পারবেন না। কারণ এগুলোর উৎপত্তি হয়েছে পুঁজি থেকে, পুঁজির শোষণ ব্যবস্থা থেকে। এ ব্যবস্থা কোনো পুরুষ-শ্রেষ্ঠত্ববাদী ব্যবস্থা নয়। কিন্তু এ ব্যবস্থা শোষণ করতে, সর্বদা পুঁজি পুঞ্জীভূত করতে উদ্বুদ্ধ করে। এ ব্যবস্থায় শোষকের পরিচয় কেবল পুরুষ নয়। এ ব্যবস্থায় পুঁজির মালিকই শোষণ করে, পুঁজির মালিকই এ ব্যবস্থার মালিক। আর, এ ব্যবস্থাটিই তো শোষণ করে। আর, শোষণের এ ব্যবস্থা তো নারী বা পুরুষ বা উভয় লিঙ্গের উপর নির্ভর করে না।

তবুও আজ পর্যন্ত সিংহভাগ এনজিও, তথাকথিত সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো, যেগুলোর বেশিরভাগই প্রকৃতপক্ষে এনজিও, এবং অনেক ক্ষেত্রেই সাম্রাজ্যবাদের সাথে যুক্ত, তারা নারী বিষয়টিকে সংকীর্ণতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখে থাকে। তারা শ্রেণির প্রসঙ্গটি, পুঁজি গরিবদের, নারী-পুরুষকে শোষণ করে, এ বিষয়টি এড়িয়ে যান। তারা উপেক্ষা করেন আধিপত্য বিস্তারকারী পুঁজি দ্বারা নির্মিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাসমূহকে, যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে শৃঙ্খলিত করে রাখে। যথার্থই জনপ্রিয় একটি রেওয়াজ বটে!

ক্লারার অবস্থান কখনই শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গীকে এড়িয়ে যায় নি। তাঁর সময়ে নারীবাদী আন্দোলন যে ধনিক শ্রেণির নারীদের, অভিজাতদের দ্বারা প্রভাবিত ছিল, সে সত্য কখনোই তাঁর চোখ এড়িয়ে যায় নি। তাই তাঁর উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম ছিল ট্রেড ইউনিয়নে শ্রমজীবী নারীদের উদ্বুদ্ধ করা, সংগঠিত করা, মজুরি শ্রমিকদের অধিকার আদায়ে ট্রেড ইউনিয়নের সংগ্রামকে শক্তিশালী করতে তাদের অনুপ্রাণিত করা।

সমতা, মর্যাদা, অধিকার ও নিরাপত্তা আদায়ের জন্য নারীদের যে লড়াই, তা ক্লারার কাছে শোষিত, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামের বিস্তৃত পরিসর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল না।

শোষণের শৃঙ্খলমুক্তির জন্য বিস্তৃত, সুদূরপ্রসারী ও গভীর যে সংগ্রাম, শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য যে সংগ্রাম, তা থেকে নারীদের লড়াই ক্লারার কাছে বিচ্ছিন্ন ছিল না। এ বিষয়গুলো বর্তমানে বুর্জোয়াদের ধারণায় প্রভাবিত, বুর্জোয়াদের বলে যাওয়া কথায় সুর মেলানো নারী-কণ্ঠে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়, উত্থাপন করা হয় না। এটি সেই একই পুরোনো খেলা! যান্ত্রিক এবং সুস্পষ্টভাবে নির্বোধ এ খেলা পুঁজিকে বিবেচনায় নেয় না। এতে পুঁজির আর্থিক গঠন, ক্ষমতা এবং পুঁজি চালিত সমগ্র সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর বিস্তৃত পুঁজির চাতুরীকে বিবেচনায় আনা হয় না। এগুলো বিবেচনায় না এনে এ খেলা ব্যক্ত হয় কতগুলো স্থূল সংখ্যা দ্বারা। যেমন: অমুক সংখ্যক পুরুষ, তমুক সংখ্যক নারী, এর এত শতাংশ, ওর অত শতাংশ, যেন কেবল সংখ্যা আর শতকরা হার দিয়ে সব বৈষম্যকে নিরূপণ করা যাবে/ নির্মূল করা যাবে। ধূর্ত বাজিকরের মতো তারা ভুলে যান যে, পৃথিবীর প্রায় সমস্ত ধন, সম্পদ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রায় সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া অল্প কয়েকজন মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। তারা এ প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যান: আজকের দুনিয়ায় পণ্য-সমৃদ্ধ প্রাসাদে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি কি নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করে দেবে? সে প্রাসাদে নারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি কি পুঁজি দ্বারা শোষিত সব নারীর জীবনে প্রাচুর্য নিয়ে আসবে? পণ্য শোভিত নারীদের মধ্যে কয়েক জন কি ইতোমধ্যে ধনীদের প্রাসাদে থেকে সেলাই কারখানায়, উৎপাদন কলে, কৃষি শিল্পে, সেবা খাতে শ্রমজীবী নারীদের শোষণ করছেন না? সেই সব শোষক, যারা বাহ্যত নারী, সেই সব নারী শোষকেরা কি শোষণ করার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ পার্থক্য বিবেচনা করেন? যুক্তরাজ্যের একদা প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার পরিচিতি পেয়েছিলেন দুধ ছিনতাইকারী* বা মিল্ক স্ন্যাচার নামে। যথার্থই তিনি লৌহ মানবী। তিনি সেখানকার প্রলেতারীয় নারীদেরকে তাদের অধিকারগুলো উপহার হিসেবে দিয়ে গিয়েছিলেন কি? এ লৌহ মানবী দরিদ্র খনি শ্রমিকদের সব বাড়ি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, যা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিপীড়িত মানুষগুলোর দুঃখ-দুর্দশা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

[*অনুবাদকের নোট: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাজ্য সরকার শিশুদের পুষ্টির চাহিদা মেটাতে ১১ বছরের কম বয়সী শিশুদের দুধ দেয়ার নিয়ম চালু করে। ১৯৭১ সালে শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে মার্গারেট থ্যাচার দুধ দেয়ার জন্য বরাদ্দ কমিয়ে দেন। এতে ১১ বছরের পরিবর্তে ৭ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করা হয়। তাই মার্গারেট থ্যাচারকে মিল্ক স্ন্যাচার বা দুধ ছিনতাইকারী বলা হতো।]

এই একই ঘটনা সেদিনের মত আজ অন্য দেশগুলোতে ঘটছে। রাজনৈতিক ক্ষমতায় এটি ছিল, এবং আছে; এটি ছিল এবং আজো আছে পুঁজির ক্ষমতায়, আইনসভায় ছিল, আজো আছে, কারখানায় ছিল এবং আজো আছে।

আবার যুক্তরাষ্ট্র বা নাইজেরিয়ার একজন শোষক, পুঁজির মালিক, বিপুল মুনাফাধারী যিনি বাহ্যত নারী, তিনি কি পুরুষ শ্রমিকের চেয়ে নারী শ্রমিকদের কম শোষণ করেন? ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধের অসংখ্য দেশে আজ এদের মত এমন কয়েকজন নারী শোষক আর লুঠেরা রয়েছেন, যাদের মধ্যে কারো কারো নাম চোরদের তালিকা হিসেবে পরিচিত পানামা পেপারসে এসেছে। বড় পুঁজির মালিক এ নারীদের সংখ্যা বা শতকরা পরিমাণ বর্তমানে কম নয়। বাংলাদেশের ম্যানুফ্যাকচারিং-পুঁজির মালিক চৌকস নারী হোক কিংবা ভারত বা আফ্রিকার কোনো দেশের জাঁকালো শিল্পপতি নারী হোক, তাদেরকে একসাথে করে বিবেচনা করা যায় একটি একক জোট হিসেবে। রাজনৈতিক ক্ষমতার বিবেচনায় এ জোট কোনো পাতি বা ছোটখাটো জোট নয়। এ জোটের রাজনৈতিক ক্ষমতা জমাট বাধে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে, নানা যোগাযোগ ও নেটওয়ার্ক বা জালের মত ছড়ানো সম্পর্কের মাধ্যমে, পুঁজির ক্ষমতার মাধ্যমে, আইনসভায়, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের নানা সমিতি-সংগঠনের মাধ্যমে। একজন ধনী নারী, যিনি পুঁজি ও কারখানার মালিক হয়ে সেখানকার নারী শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের বাড়তি মেহনত আত্মসাৎ করেন, তিনি তার পুরুষ সহকর্মীর থেকে কোনো অংশে কম ক্ষমতাশালী নন। শোষণ করার “পবিত্র” দায়িত্বের ক্ষেত্রে এ নারী মালিকগণ তাদের পুরুষ সাথীদের চেয়ে কম বর্বর নন। বুর্জোয়া নারীবাদী “বন্ধুরা” এ প্রশ্নগুলো “এড়িয়ে যান”, “দেখতে পান না”। এ বিষয়ে তারা “অজ্ঞ”। পুঁজির মালিক এবং পুঁজি দ্বারা শোষিত - এই দুই শ্রেণির বিষয়টিকে তারা বিশ্লেষণ করতে অক্ষম।

নারী বিষয়ক প্রশ্নে ক্লারার অবস্থান ছিল সুস্পষ্ট। এ বিষয়ে তিনি লেনিনের সাথে একটি দীর্ঘ কথোপকথন উদ্ধৃত করেন। এটি ছিল ১৯২০ সালে ক্রেমলিনে লেনিনের পড়ার ঘরে। ক্লারা লেখেন:

“লেনিন আবার বলে চললেন: ‘আপনাদের পাপের তালিকা এখনো সম্পূর্ণ হয়নি, ক্লারা। আমি শুনেছি যে, নারী-শ্রমিকদের পাঠ ও আলোচনা বাসরে যৌন আর বিবাহ সমস্যার কথাই প্রধানত আলোচিত হয়। রাজনৈতিক অধ্যাপনা ও জ্ঞানপ্রচার কাজের মধ্যে এই বিষয়টাই যেন সবচেয়ে বেশি মনোযোগের ব্যাপার। এ কথা যখন শুনলাম তখন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। প্রলেতারীয় একনায়কত্বের প্রথম রাষ্ট্র সমস্ত পৃথিবীর প্রতিবিপ্লবীদের সাথে লড়াই করছে। জার্মানির নিজেরও যা অবস্থা, তাতে সমস্ত প্রলেতারীয় বিপ্লবী শক্তির বিপুল সংহতি দরকার, যাতে প্রতিবিপ্লবীদের ক্রমবর্ধমান চাপের জবাব দেওয়া যায়। আর সেই সময়ে কিনা সক্রিয় কমিউনিস্ট-নারী যৌন সমস্যা আর বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ বিবাহ-পদ্ধতি নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন! তাঁরা মনে করেছেন এ ক্ষেত্রে নারী-শ্রমিকদের আলোকদান করাই তাদের প্রধান কর্তব্য। শোনা যায় যৌন প্রশ্ন নিয়ে ভিয়েনায় এক কমিউনিস্ট-লেখিকার পুস্তিকাটিই সবচেয়ে বেশি প্রচারিত। পুস্তিকাটি একদম বাজে! তাঁর ভেতর যা কিছু সঠিক কথা আছে শ্রমিকরা বহুকাল আগেই সে কথা বেবেলে পড়েছে। কিন্তু আলোচ্য পুস্তিকায় সে কথাগুলো যে-রকম ক্লান্তিকর আর নীরস ছকে বর্ণিত হয়েছে সে ভাবে নয়, চিত্তাকর্ষক আন্দোলনের আকারে, বুর্জোয়া সমাজের উপর আক্রমণে ভরা।

“ফ্রয়েডের প্রকল্প উল্লেখ করে পুস্তিকাটায় যেন বা একটা “বৈজ্ঞানিক” চেহারা দেবার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু তাহলেও এটা এক বিশ্রী জোড়াতালি ছাড়া আর কিছুই নয়। বর্তমানে ফ্রয়েডের মতবাদ এক ধরণের হুজুগে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা প্রবন্ধ, রিপোর্ট, পুস্তিকা ইত্যাদিতে- সংক্ষেপে বলতে গেলে, যা অতি প্রচুর পরিমাণে গজিয়ে উঠেছে বুর্জোয়া সমাজের বিষ্ঠা স্তূপের ওপর সেই বিশেষ ধরনের সাহিত্য - যে-সব যৌন মতবাদের কথা থাকে তার ওপর আমার আস্থা নেই। তাদের আমি বিশ্বাস করি না, যারা নাভিবিন্দুর ধ্যানে মগ্ন ভারতীয় সাধুর মতো ক্রমাগত কেবল যৌন সমস্যায় ডুবে থাকে। আমার নিজের মনে হয় যে, যৌন মতবাদের এই প্রাচুর্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেগুলি প্রকল্প, তদুপরি খেয়ালখুশি অনুসারে বানানো, এগুলি ব্যক্তিগত চাহিদার ফল। নিজের অস্বাভাবিক অথবা অত্যাধিক যৌন জীবনকে বুর্জোয়া নীতির কাছে ন্যায়সঙ্গত বলে প্রমাণ এবং নিজের জন্য প্রশ্রয় ভিক্ষার ইচ্ছে থেকেই তাদের জন্ম। বুর্জোয়া নীতির প্রতি এই প্রচ্ছন্ন শ্রদ্ধা আমার কাছে যৌন প্রশ্ন নিয়ে তন্ময়তার মতোই সমান ন্যক্কারজনক। এই কাজকে যতই বিদ্রোহী ও বিপ্লবী বলে দেখাবার চেষ্টা করা হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত এটা পুরোপুরি বুর্জোয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা বুদ্ধিজীবী ও তাদের নিকটতম সামাজিক স্তরের জীবরা বিশেষ করে পছন্দ করে। পার্টির মধ্যে, শ্রেণী-সচেতন যুদ্ধরত প্রলেতারিয়েত জনগণের মধ্যে এর স্থান নেই।‘

“এইখানটায় আমি [ক্লারা] মন্তব্য করলাম, যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানা ও বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার প্রাধান্য রয়েছে সেখানে যৌন এবং বিবাহ সমস্যা সমাজের সব শ্রেণী ও স্তরের মেয়েদের পক্ষেই বহুবিধ কর্তব্য, সংঘাত ও ক্লেশ পাকিয়ে তোলে। [...] ঐতিহাসিক ধারার মধ্যে অর্থনীতির উপর নির্ভর করে বিবাহ-পদ্ধতি ও পরিবারের রপে যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা নারী-শ্রমিকের মন থেকে বুর্জোয়া সমাজের নিত্যতা সম্পর্কে তাদের সংস্কার উচ্ছেদ করার উত্তম উপায়। এই সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিচার থেকে এগিয়ে যাওয়া দরকার বুর্জোয়া ব্যবস্থাকে নির্মমভাবে চূর্ণ করার দিকে, তার সারমর্ম ও পরিণাম ফাঁস করার দিকে, তার মিথ্যা যৌন নীতির তীব্র নিন্দাও তার অন্তর্ভুক্ত। সব পথই গেছে রোমের দিকে। সমাজের মতাদর্শগত উপসৌধের কোনো গুরুত্বপূর্ণ অংশের, কোনো অতি প্রকট সামাজিক ঘটনার প্রত্যেকটি মার্কসবাদী বিশ্লেষণেরই পৌঁছনো উচিত সমগ্রভাবে বুর্জোয়া ব্যবস্থা এবং তার ভিত্তির, অর্থাৎ ব্যক্তিগত মালিকানার বিশ্লেষণে। এবং এরূপ প্রতিটি বিশ্লেষণেরই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে যে ‘কার্থেজকে ধ্বংস করতেই হবে’।

“লেনিন হেসে মাথা হেলালেন। ‘বটে, বটে! ঠিক উকিলের মতোই দেখছি আপনি আপনার পার্টি আর কমরেডদের পক্ষ সমর্থন করেছেন। আপনি যা বলছেন নিঃসন্দেহে সেটায় খানিকটা সত্যি আছে। কিন্তু জার্মানিতে যে ভুল করা হয়েছে এটা খুব বেশি হলে তার কৈফিয়ৎ মাত্র, যৌক্তিকতা নয়। ভুল হল চিরকালই ভুল। যথার্থভাবে আপনি কি আমাকে বলতে পারেন যে পাঠ এবং আলোচনার সময় যৌন ও বিবাহের প্রশ্নগুলি আলোচিত হত অবিচলিত, জীবন্ত ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে? এর জন্য যে দরকার গভীর বহুমুখী জ্ঞান, বিশাল মালমশলার ওপর নিখুঁত মার্কসবাদী দক্ষতা। এই কাজের জন্য আজকের দিনে আপনাদের শক্তি কোথায়? যদি তা থাকত তাহলে যে-পুস্তিকার কথা আমরা উল্লেখ করেছি, সে-ধরনের পুস্তিকা সান্ধ্যপাঠ ও আলোচনা চক্রে পাঠ্যপুস্তক হিসেবে কখনো ব্যবহৃত হত না। সমালোচনা না করে এই পুস্তিকাটিকে সুপারিশ করা হচ্ছে এবং প্রচার করা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত উক্ত সমস্যার এই অসন্তোষজনক, অ-মার্কসবাদী আলোচনাটা কোথায় দাঁড়ায়? দাঁড়ায় এই যে, প্রধান সামাজিক সমস্যার অংশ হিসেবে যৌন এবং বিবাহ সমস্যাকে দেখা হচ্ছে না। বরঞ্চ উল্টো, বৃহৎ সামাজিক সমস্যাকেই মনে হবে যৌন সমস্যার এক অংশ, এক উপাঙ্গ বলে। মুখ্য কথাটাই পিছিয়ে পড়ে গৌণ হয়ে দাঁড়াবে। এতে শুধুই প্রশ্নটির প্রাঞ্জলতা ব্যাহত হবে না, সমস্ত চিন্তাপ্রণালীকেই সে-ঘটনা কুয়াশাচ্ছন্ন করবে, নারী-শ্রমিকদের শ্রেণী সচেতনতাকেই অন্ধকার করবে।

“[লেনিন বলেন:] ‘[...] জ্ঞানী সলমন বলেছিলেন সব জিনিসেরই উপযুক্ত সময় আছে। বলুন তো, এটা কি মাসের পর মাস নারী-শ্রমিকদের এই প্রশ্নের মধ্যে আবদ্ধ রাখার সময় – কী করে লোকে ভালোবাসে ও ভালোবাসা পায়, কী করে আদর করে ও আদর নেয়? [...] বর্তমান দিনে নারী-শ্রমিকদের সমস্ত চিন্তা প্রলেতারীয় বিপ্লবের দিকে নিবদ্ধ থাকা প্রয়োজন। এই বিপ্লবই অন্যান্য নানা বিষয়ের মতো বিবাহ এবং যৌন সম্পর্কের মধ্যেও আসল নতুনত্বের ভিত্তি স্থাপন করবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে অস্ট্রেলিয়ার নিগ্রোদের মধ্যেকার বিবাহ-পদ্ধতি এবং আদিম যুগের আন্তঃপারিবারিক বিবাহরীতির কথা আলোচনা করার চেয়ে অন্যান্য সমস্যাই সামনে আসছে বৈকি।[...]’

“[লেনিন বলেন:] আমাকেও সঙ্কীর্ণচিত্ত বলে যথেষ্ট সন্দেহ করা হয়। কিন্তু তাতে আমি উত্তেজিত হই না। হলদেচঞ্চু পক্ষী-শাবকরা, সবে যারা বুর্জোয়া মতবাদের ডিমের খোলস ছেড়ে বেরিয়েছে তারা সবাই দারণ বুদ্ধিমান। নিজেদের পথ পরিবর্তন না করে ব্যাপারটার সঙ্গে আমাদের মানিয়ে নিতে হবে। যৌন সমস্যার আধুনিক উপস্থাপন এবং তার অত্যধিক আকর্ষণে যুব আন্দোলনও পীড়িত।' ‘আধুনিক’ এই কথাটির উপর লেনিন ব্যঙ্গময় জোর দিলেন কিন্তু সেই সঙ্গেই সেটা চাপা দিয়ে বললেন। ‘আমি শুনেছি যে আপনাদের দেশের যুব সংঘের মধ্যেও যৌন সমস্যা হল আলোচনার এক প্রিয় বিষয়বস্তু। [বাংলাদেশসহ কিছু দেশে প্রগতিশীল হিসেবে পরিচয় প্রদানকারী গোষ্ঠীগুলোও একই চর্চা করে।] শুনেছি এ বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য নাকি যথেষ্ট বক্তা নেই। এই বিদঘুটে ব্যাপারটা হল যুব-আন্দোলনের পক্ষে বিশেষ করে ক্ষতিকর, বিশেষ করে বিপজ্জনক। এর থেকে সহজেই কোনো কোনো লোকের ক্ষেত্রে যৌন উচ্ছৃঙ্খলতা, অত্যধিক যৌন উত্তেজনা এবং তরুণদের স্বাস্থ্য ও শক্তির অপচয় হতে পারে। এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধেও আপনাকে লড়াই করতে হবে। [...]

ক্লারা এ আলাপের বিশদ বিবরণ দিয়ে নিজ মন্তব্য যোগ করেন। তাঁর সে মন্তব্য ছিল: “দুর্ভোগ-দুর্দশার জীবনে বিধ্বস্ত নারী-পুরুষ প্রলেতারিয়েত দেহ-মনের মত এক, অবিভাজ্য সত্ত্বা। তাই, একইভাবে, পুঁজির প্রতি প্রজ্জ্বলন্ত ঘৃণায়ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে বিপ্লবের লড়াইতে আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে, আরো দুঃসাহসী ইচ্ছাশক্তি নিয়ে।” (মাই মেমোরেন্ডাম বুক, ফেব্রুয়ারি ১৯২২। দীর্ঘ উদ্ধৃতি অপছন্দ করেন এমন বন্ধুদের কাছে আমি ক্ষমা চাইছি।)

নারী বিষয়ক প্রশ্নে, নারীদের শৃঙ্খল-মোচনের প্রশ্নে সংস্কার সাধন ও আমূল পরিবর্তনের বিষয়টি বাদ দেয়া যায় না।

ক্লারা তার অবস্থান পরিষ্কার করে লেখেন: “[...] সংস্কার সাধন শ্রমজীবী শ্রেণির অবস্থার উন্নতি করে, মজুরদের উপর পুঁজিবাদের শৃঙ্খলভার লাঘব করে । কিন্তু এগুলো পুঁজিবাদকে গুঁড়িয়ে দিতে এবং এর স্বেচ্ছাচার থেকে শ্রমিকদের মুক্ত করতে যথেষ্ট নয়।” (“দ্যা ওয়ার্কার্স ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভেল”, জাস্টিস, ১লা মে, ১৮৯৯)

আলেকজান্দ্রা কলন্তাই অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করেছেন। তিনি কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর কথা উল্লেখ করে বলেন: পুস্তিকাটি “বর্তমানে বিরাজমান সামগ্রিক প্রলেতারীয় সমস্যার সঙ্গে নারী বিষয়টির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রথম নির্দেশ করেছিল। এটি তথ্য-প্রমাণ খুঁজে বের করে দেখিয়ে দিয়েছিল যে, এ ব্যবস্থায় পুঁজি ক্রমাগত নারীদেরকে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় টেনে আনে এবং নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রলেতারীয়েতের মহান সংগ্রামে তাকেও সহযোদ্ধা করে তোলে।” (“নারী বিষয়টির সামাজিক ভিত্তি বইটির ভূমিকা”, আলেকজান্দ্রা কলন্তাই: নির্বাচিত প্রবন্ধ ও বক্তৃতা, প্রগতি প্রকাশনী, মস্কো, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৮৪)

কলন্তাই একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেন: “সমগ্র পুঁজিবাদী-শোষণ ব্যবস্থা, যে ব্যবস্থা একই সাথে একজন মানুষ হিসেবে এবং একজন নারী হিসেবে তাকে তাড়া করে, সেটি বিরাজমান থাকলে, নারীদের রাজনৈতিক সমতা কি দুর্ভাগ্য ও দুর্দশার অতল গহ্বর থেকে শ্রমজীবী নারীদের মুক্ত করতে পারবে?” (প্রাগুক্ত)

তাই আলেকজান্দ্রা কলন্তাই দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, “প্রলেতারীয় নারীর চরম উদ্দেশ্য হল পুরনো দ্বন্দ্বরত শ্রেণি ভিত্তিক দুনিয়ার পতন ঘটানো এবং একটি নতুন ও উত্তমতর পৃথিবী গড়ে তোলা, যেখানে মানুষ দ্বারা মানুষের শোষণ হবে অসম্ভব।” (প্রাগুক্ত)

আজকালকার বেশিরভাগ নারীবাদী আন্দোলন, যেগুলো প্রধানত বুর্জোয়া ধ্যানধারণা ও এনজিওর অর্থ দ্বারা চালিত, সেগুলো ক্লারার কথা উল্লেখ করতে পছন্দ করে না। কারণ পেত্রোগ্রাদে সংগ্রামী অভিযাত্রায় অংশ নেয়া হাজার হাজার প্রলেতারীয় নারীই ১৯১৭ সালের ৮ই মার্চ রাশিয়ার বিপ্লবের দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। এ প্রলেতারীয় নারীরা ছিলেন সেই বিপ্লবের অগ্রদূত, যে বিপ্লব মানব ইতিহাসে অভূতপূর্ব। কারণ এ বিপ্লব একটি শোষক শ্রেণির স্থানে আরেকটি শোষক শ্রেণিকে বসায় নি, বরং শোষক শ্রেণিকে সমূলে উৎপাটিত করেছিল এবং সে স্থান শোষিত শ্রেণি দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেছিল।

অনুবাদক বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় হতে উত্তীর্ণ একজন প্রকৌশলী।

Back to Home Page

Frontier
Jul 6, 2020


Omar Raad Chowdhury omar.raad.chowdhury@gmail.com

Your Comment if any